বিদেশে যেতে চান কিন্তু অর্থের অভাবে পারছেন না? অথবা প্রবাস থেকে ফিরে দেশে নতুন কিছু শুরু করার কথা ভাবছেন? আপনার এই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পাশে আছে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। সহজ শর্তে ও কম সুদে বিভিন্ন ধরনের লোন সুবিধা দিয়ে প্রবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে এই ব্যাংকটি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অনেকেই জানতে চান, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন অনলাইন আবেদন করা যায় কি না। কীভাবে আবেদন করতে হয়, কী কী কাগজপত্র লাগে, আর কারা এই লোন পাওয়ার যোগ্য—এইসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন।
আপনার সকল প্রশ্নের অবসান ঘটাতে আমাদের আজকের এই আর্টিকেল। এখানে আমরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন সম্পর্কিত সকল তথ্য A-Z আলোচনা করব। চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
Table of Contents
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন আসলে কী?
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা মূলত প্রবাসীদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের সহায়তা করা, প্রবাস থেকে ফেরত আসা কর্মীদের পুনর্বাসন এবং তাদের পরিবারকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে এই ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের ঋণ বা লোন প্রদান করে থাকে।
অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় এর সুদের হার কম এবং শর্তও অনেক সহজ। যা এটিকে প্রবাসীদের জন্য একটি আস্থার প্রতীক করে তুলেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক কি কি লোন দেয়?
বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মূলত ৪ ধরনের বিশেষ লোন স্কিমের মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে আসছে। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নিতে পারেন সেরা স্কিমটি। নিচে প্রতিটি স্কিম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. অভিবাসন ঋণ
যারা বৈধভাবে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন কিন্তু যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করতে পারছেন না, তাদের জন্য এই ঋণ।
- উদ্দেশ্য: ভিসা, বিমান ভাড়া, এবং বিদেশে যাওয়ার প্রাথমিক খরচ মেটানো।
- ঋণের পরিমাণ: সাধারণত ১ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত (ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী পরিবর্তনশীল)।
- সুদের হার: বাৎসরিক মাত্র ৯% (সরল সুদ)।
- পরিশোধের মেয়াদ: সর্বোচ্চ ২ বছর (গ্রেস পিরিয়ড সহ)।
২. পুনর্বাসন ঋণ
দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়ে যারা দেশে ফিরে এসেছেন এবং নিজের জমানো টাকায় ব্যবসা, কৃষি খামার বা অন্য কোনো উৎপাদনমুখী প্রকল্প শুরু করতে চান, তাদের জন্য এই ঋণ।
- উদ্দেশ্য: দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করা।
- ঋণের পরিমাণ:
- জামানতবিহীন: সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা।
- জামানতসহ: প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
- সুদের হার: ৯%।
- পরিশোধের মেয়াদ: প্রকল্পের ধরন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫ বছর।
৩. অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ
বিদেশে কর্মরত কোনো প্রবাসী যদি তার পরিবারের আর্থিক প্রয়োজনে (যেমন: চিকিৎসা, শিক্ষা, বিয়ে) দেশে টাকা পাঠাতে চান অথবা দেশে ফিরে বড় কোনো ব্যবসা করতে চান, তবে এই ঋণ নিতে পারবেন।
- উদ্দেশ্য: প্রবাসীর পরিবারের জীবনমান উন্নয়ন ও বড় আকারের প্রকল্পে বিনিয়োগ।
- ঋণের পরিমাণ: জামানতসহ সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
- সুদের হার: ৯%।
- বিশেষ সুবিধা: প্রবাসী বিদেশে থাকা অবস্থায় তার পরিবারের সদস্য (বাবা-মা, স্বামী/স্ত্রী, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান) এই ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন।
৪. বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ
মূলত কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের স্বাবলম্বী করার জন্য এই স্কিমটি চালু করা হয়েছিল। এটি এখনও চলমান রয়েছে।
- উদ্দেশ্য: বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফেরত আসা কর্মীদের দ্রুত পুনর্বাসন।
- ঋণের পরিমাণ: জামানতবিহীন সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ টাকা এবং জামানতসহ সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা। গ্রুপ লোনের ক্ষেত্রে (৫ জনের গ্রুপ) প্রত্যেকে ৫ লক্ষ টাকা করে সর্বোচ্চ ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।
- সুদের হার: ৯%।
- পরিশোধের মেয়াদ: সর্বোচ্চ ৩ বছর।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন অনলাইন আবেদন: বাস্তবতা কী?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, অনলাইনে কি আবেদন করা যায়? উত্তরটি হলো: না। বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোনের জন্য সরাসরি অনলাইনে আবেদন করার কোনো ব্যবস্থা চালু করেনি। লোন পেতে হলে আপনাকে আবশ্যিকভাবে আপনার নিকটস্থ ব্যাংকের শাখায় গিয়ে ফরম পূরণ করে আবেদন জমা দিতে হবে।
তবে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর আপনার লোনের স্ট্যাটাস (যেমন: অনুমোদন বা বাতিল) সম্পর্কে আপনাকে মোবাইল ফোনে এসএমএস-এর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে।
লোন পাওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?
লোন অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যাংক কিছু যোগ্যতা যাচাই করে। আবেদন করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি যোগ্য কি না। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নিতে নিম্নোক্ত যোগ্যতাগুলো থাকতে হবে —
- আবেদনকারীকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
- সর্বনিম্ন বয়স ২১ বছর হতে হবে (কিছু ক্ষেত্রে ১৮ বছর)।
- আবেদনকারীকে অবশ্যই ব্যাংকের শাখার অধিক্ষেত্রের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
- অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণখেলাপি হওয়া যাবে না।
- বৈধ কাগজপত্র:
- অভিবাসন ঋণের জন্য: বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা এবং BMET (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো)-এর স্মার্ট কার্ড থাকতে হবে।
- পুনর্বাসন ঋণের জন্য: ব্যবসার বা প্রকল্পের উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকতে হবে।
- কমপক্ষে ২ জন উপযুক্ত জামিনদার থাকতে হবে, যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল।
লোন নিতে কী কী কাগজপত্র প্রয়োজন?
আবেদন করার আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিলে আপনার সময় বাঁচবে এবং প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। নিচে একটি চেকলিস্ট দেওয়া হলো:
আবেদনকারীর জন্য:
- পূরণকৃত ঋণ আবেদন ফরম।
- আবেদনকারীর সদ্য তোলা ৪ কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি।
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), পাসপোর্ট এবং ভিসার ফটোকপি (অভিবাসন ঋণের জন্য)।
- বিএমইটি স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
- বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র (নাগরিকত্ব সনদ/বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র/বিদ্যুৎ বিলের কপি)।
জামিনদারদের জন্য:
- প্রত্যেক জামিনদারের ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
- স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানার প্রমাণপত্র।
- আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণ (ব্যাংক স্টেটমেন্ট/চাকরির প্রত্যয়নপত্র)।
- জামিনদারের স্বাক্ষর করা ব্যাংকের ৩টি চেকের পাতা।
ব্যবসার জন্য (পুনর্বাসন/বৃহৎ ঋণ):
- ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি (যদি থাকে)।
- ব্যবসার ঠিকানা, উদ্দেশ্য এবং গত এক বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব সম্বলিত একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত কাগজপত্রের প্রয়োজন হতে পারে। এ বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা আপনাকে বিস্তারিত জানাবেন।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন আবেদন পদ্ধতি (ধাপে ধাপে)
যদিও অনলাইনে আবেদন করা যায় না, তবে অফলাইন প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ। নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
- ধাপ ১: শাখা নির্ধারণ ও আলোচনাপ্রথমে আপনার ঠিকানা অনুযায়ী নিকটস্থ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখা খুঁজে বের করুন। সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তার সাথে আপনার লোনের প্রয়োজন ও ধরন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করুন।
- ধাপ ২: আবেদন ফরম সংগ্রহ ও পূরণকর্মকর্তা আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক আবেদন ফরমটি দেবেন। ফরমটি সতর্কতার সাথে কোনো ভুল তথ্য না দিয়ে পূরণ করুন।
- ধাপ ৩: কাগজপত্র সংযুক্ত ও জমাপূরণ করা ফরমের সাথে উপরে উল্লিখিত সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে ব্যাংকে জমা দিন।
- ধাপ ৪: যাচাই-বাছাই ও অনুমোদনব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপনার দেওয়া তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করবে। সবকিছু ঠিক থাকলে এবং আপনি যোগ্য বিবেচিত হলে আপনার লোনটি অনুমোদন করা হবে।
- ধাপ ৫: চূড়ান্ত অনুমোদন ও অর্থ উত্তোলনলোন অনুমোদিত হলে আপনাকে মোবাইল ফোনে মেসেজ বা কল করে জানানো হবে। এরপর আপনি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ঋণের টাকা তুলতে পারবেন।
শেষ কথা
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক শুধুমাত্র একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি লক্ষ লক্ষ প্রবাসীর স্বপ্ন পূরণের সারথি। আপনি যদি বিদেশে যেতে বা দেশেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান, তবে এই ব্যাংকের লোন সুবিধা আপনার জন্য দারুণ একটি সুযোগ হতে পারে।
লোন নেওয়ার আগে অবশ্যই নিজের সক্ষমতা যাচাই করুন এবং সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। একটি সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা আপনার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য আপনার নিকটস্থ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখায় আজই যোগাযোগ করুন।





