ব্যবসা শুরু করতে চান, কৃষিকাজে উন্নতি করতে চান, কিংবা বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, কিন্তু আর্থিক সংস্থান নিয়ে চিন্তিত? ব্যাংক লোনের জটিল প্রক্রিয়া যদি আপনার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তবে আপনার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সমাধান হতে পারে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র (Proshika)।
বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে সুপরিচিত এবং কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই এনজিওটি শুধু একটি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক অন্যতম সারথি। তাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মধ্যে প্রশিকা এনজিও লোন অন্যতম, যা হাজারো মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা প্রশিকা এনজিও লোন কী, এর প্রকারভেদ, যোগ্যতা, আবেদন প্রক্রিয়া, সুদের হার এবং অন্যান্য সকল খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
Table of Contents
প্রশিকা এনজিও: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেওয়ার আগে তার প্রেক্ষাপট জানা জরুরি। “প্রশিকা” (প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও কাজ) ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং পুরোনো একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। এর মূল লক্ষ্য হলো দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা তৈরি, তাদের সংগঠিত করা এবং তাদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভরশীল সমাজ গঠন করা।
প্রশিকার কার্যক্রম শুধু ক্ষুদ্রঋণেই সীমাবদ্ধ নয়। সংস্থাটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক বনায়নের মতো বহুবিধ ক্ষেত্রে কয়েক দশক ধরে যুগান্তকারী কাজ করে আসছে।
প্রশিকা এনজিও লোন আসলে কী?
প্রশিকা এনজিও লোন হলো এই সংস্থার অধীনে পরিচালিত একটি সমন্বিত আর্থিক সেবা, যা বিশেষভাবে দেশের গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি প্রচলিত অর্থে শুধু একটি ঋণ নয়, বরং এটি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং টেকসই জীবিকা অর্জনের একটি মাধ্যম।
যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য, বিশেষ করে নারীদের জন্য, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব, সেখানে প্রশিকা সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে। এই ঋণের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা, কৃষির আধুনিকায়ন করা এবং প্রতিটি পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা।
এই লোনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
প্রশিকা এনজিও লোনের বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এটিকে সাধারণ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
- উদ্দেশ্যভিত্তিক ঋণ: আবেদনকারীর প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে (যেমন: কৃষি, ব্যবসা, শিক্ষা, বিদেশ গমন) ঋণ প্রদান করা হয়।
- সহজ শর্তাবলী: ব্যাংক লোনের মতো জটিল কাগজপত্র বা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না।
- প্রতিযোগিতামূলক সার্ভিস চার্জ: ঋণের সার্ভিস চার্জ বা সুদের হার মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (MRA) কর্তৃক নির্ধারিত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- পরিশোধের নমনীয় মেয়াদ: ঋণের পরিমাণ ও ধরন অনুযায়ী কিস্তি পরিশোধের জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়। প্রশিকার তথ্য অনুযায়ী, অনেক ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৫টি কিস্তির সুবিধা রয়েছে।
- নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার: প্রশিকা নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী, তাই নারী আবেদনকারীদের ঋণ প্রদানে এবং তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
- সদস্যদের প্রশিক্ষণ: প্রশিকা শুধু ঋণ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে না, বরং সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ (যেমন: আধুনিক কৃষি, খামার ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা পরিচালনা) দিয়ে তাদের দক্ষ করে তোলে।
প্রশিকা এনজিও থেকে কী কী ধরনের লোন পাওয়া যায়?
প্রশিকা বিভিন্ন প্রয়োজন অনুযায়ী নানা ধরনের ঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ: নতুন ব্যবসা শুরু করতে বা বর্তমান ব্যবসাকে আরও বড় করতে (যেমন: মুদি দোকান, টেইলারিং, হস্তশিল্প, পোল্ট্রি খামার) এই ঋণ দেওয়া হয়।
- কৃষি ও মৎস্যচাষ ঋণ: কৃষকদের জন্য বিশেষ এই স্কিমে সার, বীজ, কীটনাশক কেনা, সেচযন্ত্র স্থাপন, গরু-ছাগল পালন বা পুকুরে মাছ চাষের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
- জীবনমান উন্নয়ন ঋণ: এই স্কিমের আওতায় সদস্যরা ঘরবাড়ি মেরামত বা নির্মাণ, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি এবং সন্তানদের পড়াশোনার খরচের জন্য ঋণ নিতে পারেন।
- বৈদেশিক কর্মসংস্থান ঋণ: যারা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে যেতে চান, তাদের প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর জন্য প্রশিকা বিশেষ ঋণ সুবিধা প্রদান করে থাকে, যা বাংলাদেশের এনজিওগুলোর মধ্যে একটি অনন্য উদ্যোগ।
লোন পাওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?
- নাগরিকত্ব ও বয়স: আবেদনকারীকে অবশ্যই বাংলাদেশী নাগরিক এবং তার বয়স সর্বনিম্ন ১৮ ও সর্বোচ্চ ৬৫ বছরের মধ্যে হতে হবে।
- বৈবাহিক অবস্থা: প্রশিকার অন্যতম একটি শর্ত হলো, আবেদনকারীকে সাধারণত বিবাহিত হতে হয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে (যেমন: নারী সদস্য বা বিধবা) শাখার আলোচনার সাপেক্ষে এই নিয়ম শিথিলযোগ্য হতে পারে।
- সদস্যপদ: আবেদনকারীকে প্রশিকার কোনো স্থানীয় সমিতি বা দলের সদস্য হতে হবে এবং নিয়মিত সভায় অংশগ্রহণ ও সঞ্চয় জমা করতে হবে।
- স্থায়ী বাসিন্দা: আবেদনকারীকে প্রশিকার নির্দিষ্ট কর্ম-এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
- সততা ও স্বচ্ছতা: আবেদনকারী পূর্বে অন্য কোনো ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণখেলাপি হননি—এমন স্বচ্ছ রেকর্ড থাকতে হবে।
- আর্থিক সক্ষমতা: আবেদনকারীকে ঋণের কিস্তি পরিশোধে আর্থিকভাবে সক্ষম হতে হবে এবং এর স্বপক্ষে প্রমাণ বা পরিকল্পনা দেখাতে হবে।
- জামিনদার: একজন স্থানীয় জামিনদার বা গ্যারান্টারের প্রয়োজন হয়, যিনি আবেদনকারীর পক্ষে নিশ্চয়তা প্রদান করবেন।
আবেদনের জন্য কী কী কাগজপত্র প্রয়োজন?
- সঠিকভাবে পূরণকৃত ঋণের আবেদন ফরম।
- আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) বা স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি।
- আবেদনকারীর সদ্য তোলা ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি (বিবাহিতদের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর যৌথ ছবি প্রয়োজন হতে পারে)।
- একজন নমিনি বা জামিনদারের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও ১ কপি ছবি।
- আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে যেকোনো কাগজপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
প্রশিকা এনজিও লোন আবেদন প্রক্রিয়া (ধাপে ধাপে)
- ধাপ ১: শাখা অফিসে যোগাযোগ ও দলভুক্তিআপনার নিকটস্থ প্রশিকা এনজিওর শাখায় যান এবং সেখানকার কর্মকর্তার সাথে আপনার ঋণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করুন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় কোনো দলে যোগ দিন।
- ধাপ ২: নিয়মিত সভা ও সঞ্চয়দলে যোগদানের পর আপনাকে নিয়মিত সাপ্তাহিক সভায় উপস্থিত থাকতে হবে এবং নির্ধারিত পরিমাণ সঞ্চয় জমা করতে হবে।
- ধাপ ৩: আবেদন ফরম পূরণ ও জমাদলের সদস্য হিসেবে কিছুদিন নিয়মিত থাকার পর আপনি ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। শাখা থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করে নির্ভুলভাবে পূরণ করুন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দিন।
- ধাপ ৪: যাচাই-বাছাইআবেদন জমা দেওয়ার পর, প্রশিকার মাঠকর্মী আপনার বাড়ি, ঠিকানা এবং ঋণের প্রস্তাবিত প্রকল্প (ব্যবসা) পরিদর্শন করবেন।
- ধাপ ৫: লোন অনুমোদন ও বিতরণমাঠকর্মীর ইতিবাচক রিপোর্টের ভিত্তিতে আপনার আবেদনটি অনুমোদন করা হবে এবং আপনাকে ঋণের টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
প্রশিকা এনজিওর সুদের হার কত?
প্রশিকার ঋণের সুদের হার বা সার্ভিস চার্জ ১১% থেকে ২৪% পর্যন্ত হতে পারে। এটি মূলত ঋণের ধরন, পরিমাণ এবং পরিশোধের মেয়াদের উপর নির্ভর করে। এটি MRA-এর নীতিমালা অনুসরণ করে নির্ধারিত হয়। আপনার নির্দিষ্ট ঋণের জন্য সুদের হার জানতে নিকটস্থ শাখায় যোগাযোগ করুন।
অবিবাহিতরা কি আসলেই লোন পায় না?
প্রশিকার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী বিবাহিতদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে, এটি একটি কঠোর নিয়ম নয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেমন—নারী উদ্যোক্তা বা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হলে, শাখার ব্যবস্থাপক বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন। তাই আপনার পরিস্থিতি জানিয়ে শাখায় কথা বলাই সবচেয়ে ভালো।
প্রথমবার কত টাকা লোন পাওয়া সম্ভব?
প্রথমবার ঋণের পরিমাণ সাধারণত ৫,০০০ টাকা থেকে শুরু হয়। আপনার নিয়মিত উপস্থিতি, সঞ্চয় এবং পরিশোধের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে ঋণের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। আপনি যদি প্রথম ঋণ সময়মতো পরিশোধ করেন, তবে পরবর্তীতে ধাপে ধাপে আরও বড় অংকের ঋণ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
লোন পরিশোধ করতে কতদিন সময় পাওয়া যায়?
ঋণের পরিমাণ ও ধরনের উপর ভিত্তি করে পরিশোধের মেয়াদ নির্ধারিত হয়। অনেক ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৫টি সাপ্তাহিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ থাকে, যা প্রায় এক বছরের সমান।
শেষ কথা
প্রশিকা এনজিও লোন বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কেবল একটি আর্থিক সেবা নয়, এটি তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এবং আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার একটি অবলম্বন। এর সমন্বিত উন্নয়ন মডেল (ঋণের সাথে প্রশিক্ষণ) প্রান্তিক মানুষের জীবনে সত্যিকারের পরিবর্তন আনছে।
আপনার যদি একটি ভালো পরিকল্পনা এবং পরিশ্রম করার ইচ্ছা থাকে, তবে এই ক্ষুদ্রঋণই হতে পারে আপনার স্বাবলম্বী হওয়ার চাবিকাঠি। আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য আজই আপনার নিকটস্থ প্রশিকা এনজিওর শাখায় যোগাযোগ করুন।





